যাঁরা ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা প্রভৃতি দেশ থেকে বাংলাদেশে যাওয়া-আসা করেন, তাঁদের অনেকেরই ট্রানজিট মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। কাতার, কুয়েত, আরব আমিরাত, বাহরাইন, সৌদি আরব প্রভৃতি দেশের ট্রানজিট নিয়ে তাঁদের খুবই অস্বস্তি। তাঁরা জানেন, একদল শ্রমজীবী মানুষ উড়োজাহাজে উঠবেন, তাঁদের আচরণ সম্পর্কে তাঁরা বিচিত্র সব গল্প শুনেছেন। নিজেরাও কিছু কিছু খেয়াল করেছেন।

যেমন, সিটে বসতে চান না, হাঁটাহাঁটি করেন, উচ্চৈস্বরে কথা বলেন ও পরস্পরকে ডাকাডাকি করেন। সিট বেল্ট পরতে চান না। মাস্ক পরতে চান না। শৌচাগার নষ্ট করেন। কেবিন ক্রুদের সঙ্গে বচসা করেন। খাবারের প্যাকেটসহ এটা-ওটার খোলস এদিক-ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখেন। অন্য যাত্রীদের ব্যক্তিগত প্রশ্ন করে বসেন। এয়ার হোস্টেসদের সঙ্গে সেলফি তুলতে পীড়াপীড়ি করেন। ব্যাগেজের ওজনের সীমা-পরিসীমার নিয়মকানুন মানেন না। ভ্রমণকালীন আচরণজ্ঞান প্রায় শূন্যের কোঠায়। বিব্রতকর আচরণ করেন। হুট করে অনুরোধ করে বসেন তাদের ল্যান্ডিং ফরম, ডিক্লারেশন প্রভৃতি পূরণ করে দেওয়ার জন্য। দুই-একজন ফরম পূরণ করে দেওয়ার বিনিময়ে বকশিশও দিতে চান। কেউ কেউ জোরাজুরিও করেন। কেউ কেউ দু-একটি কথাবার্তার পরই ফেসবুক আইডি চেয়ে বসেন। যাত্রীদের দু-একজন এয়ার হোস্টেসদের ডাকেন। সিটটি বদলে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন, ইত্যাদি।
 
মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমজীবীদের অভব্য, গেঁয়ো, কাণ্ডজ্ঞানহীন, অমার্জিত ও বিরক্তিকর হিসেবে তুলে ধরার জন্য এরকম অজস্র গল্প আবিষ্কার করে রেখেছি। তাতে আমাদের শহুরে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্তরা যে তাঁদের বহু পেছনে ফেলে কত এগিয়ে গেছি, বোঝানো যায়। অথবা নিজেদের আধুনিক ও গুরুত্বপূর্ণ মানুষ দেখিয়ে আত্মপ্রসাদ বোধ করা যায়।
 

প্রবাসী শ্রমজীবীদের কেউ কেউ এ রকম আচরণ করেন বটে, তবে তাঁরা আসলেই খুব কম। কিন্তু মধ্যবিত্তের আত্মম্ভর ও উন্নাসিক চোখে তাঁদের এই সীমাবদ্ধতাগুলো অনেক বড় জ্বালাতন হয়ে ধরা পড়ে। অল্প কয়েকজনের আচরণ-সমস্যার বদনাম হরেদরে সব শ্রমজীবীর ঘাড়ে তুলে দেওয়া হয়। অতিসরলীকরণের ফলে এ রকম ধারণা প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে যে এরা সবাই সভ্য সমাজে মানিয়ে চলার অনুপযুক্ত।

আসলে তাঁদের নিয়ে বেশির ভাগ গল্পই কষ্টকল্পিত ও মনগড়া। মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের মানসচোখ প্রান্তজনের তিলকে তাল করে দেখে। গল্পকারেরাও ভুলেই যান যে সব শ্রমজীবীই নিরক্ষর নন। অনেকেই আছেন স্কুল-কলেজ পড়া। বিস্ময় নিয়েই তাঁরা আধুনিক দুনিয়ার হাল-হাকিকত শেখেন, জানেন এবং অন্যদের জানান। সংসারে উত্তর-প্রজন্ম যেন শিক্ষিত হতে পারে, সে জন্য তাঁদের শিক্ষার পেছনে খরচেও কার্পণ্য করেন না। প্রয়োজনে দিন-রাত প্রাণান্ত পরিশ্রম করেন। বেশির ভাগই উড়োযানে আচরণের নিয়মকানুনও ঠিকঠাক রপ্ত করেছেন। সেগুলো মেনে চলার চেষ্টাও করেন।

আমি ব্যক্তিগতভাবে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে ভ্রমণ করেছি। ভ্রমণকালে ইচ্ছেমতো কথা বলেছি। ভ্রমণকালের বাইরেও বহু শ্রমজীবীর সঙ্গে কথা বলেছি। পরিচিত ও স্বজনদের মধ্যেও কেউ কেউ শ্রমজীবী আছেন। তাঁরা তাঁদের আচরণের যে ব্যাখ্যা দেন, সেগুলো আমাদের শোনা দরকার। প্রবাসে স্বজনহীন ভালোবাসাহীন নিষ্ঠুর কাজের পরিবেশ। হাড়ভাঙা কষ্টকর খাটুনি। সেসব ক্লান্তিকর দিনগুলো শেষে দেশে ফেরার যে আনন্দ-উচ্ছ্বাস-উচ্ছলতা, মা-বাবা, ভাই-বোনের বুকে ফেরার তাড়া ও তাড়না, বন্ধু ও স্বজনদের সঙ্গলাভের তীব্র ক্ষুধা—সেগুলোরই এক ধরনের স্থূল প্রকাশ ঘটে যায় তাদের কারও কারও তাড়াহুড়ো-অস্থিরতা ইত্যাদির মধ্যে। তাই বিমান রানওয়ে স্পর্শ করতে না করতেই তাঁরা দাঁড়িয়ে পড়েন। তবে সবাই এমনটি করেন—এটা অসত্য ও বাড়াবাড়ি অভিযোগ।